ব্রিটিশ রাজত্ব এ পৃথিবীকে অনেক কিছুই দিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন এ পৃথিবীর অর্ধেক তারা শাসন করতো। শিল্প, সাহিত্য, উদ্ভাবনা- সবকিছুতেই তাদের অনেক অবদান ছিল। কিন্তু তাদের সবকিছুই কি এরকম অসাধারণ ছিল? মোটেই তা নয়। কোহিনূর হীরার আলোয় উজ্জ্বল মুকুটের আড়ালে রয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ রাজত্বের বহু অন্ধকার অধ্যায়।

১। দ্য বোয়ের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প

আমরা হয়তো শুধু হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা জানি, যেখানে তার বিরোধীদের আটকে রেখে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হতো। কিন্তু ব্রিটিশরাও কিন্তু পিছিয়ে ছিল না। ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটিশদের দরকার ছিল বিক্ষোভরত দক্ষিণ আফ্রিকানদের শায়েস্তা করা। আর এর জন্য আগমণ ঘটলো তাদের বন্দী করে রাখার উপায়- কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।

উত্তপ্ত সূর্যের নিচে অবস্থিত এ ক্যাম্পগুলো পোকা-মাকড়ে পূর্ণ থাকতো আর ভেতরের জায়গাটুকু ছিল বন্দীতে ঠাসা। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণবিহীন এ ক্যম্পগুলো ছিল বিভিন্ন মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছুই ছিল না ও ক্যাম্পের প্রহরারক্ষীরা অনেক সময় তুচ্ছ কারণে বন্দীদের সামান্য খাবারটুকুও কেড়ে নিত। ফলে অপুষ্টি ও মহামারী ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মত। হাজার হাজার নারী-শিশু মারা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়েরের সেই ব্রিটিশ ক্যাম্পে ১০ ভাগ জনগণ সেই ক্যাম্পের ভেতর মারা যায়, যাদের মাঝে শিশুই ছিল ২২ হাজার। এছাড়াও ২০ হাজার লোককে শ্রমিক ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করা হয়।

২। এডেনের টর্চার সেন্টার

ইয়েমেন, ১৯৬০। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পুরো দেশ উত্তাল। ব্রিটিশদের অবিলম্বে দেশ ছেড়ে চলে যাবার দাবী জোরদার হচ্ছে। আর এই আন্দোলন থামাতে ব্রিটিশরা বেছে নিল ঘৃণ্য এক পথ। এতটাই ভয়াবহ টর্চার সেন্টার বা বন্দী নির্যাতন কেন্দ্র তৈরি করলো, যে কারো জন্যই এর বর্ণনা সহ্য করা অসম্ভব। বন্দীদের নগ্ন দেহে রাখা হত চরম ঠান্ডা কোন কক্ষে। অনেক সময় তাদের নিউমোনিয়া হয়ে যেত। বন্দীদের প্রহরীরা সিগারেটের ছ্যাঁকা দিত ও মারধর করতো। আর সবচেয়ে বাজে ছিল যৌন নির্যাতন। ১৯৬৬ সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সারা বিশ্ব বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে যায়, খোদ ব্রিটেনেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।

৩। সাইপ্রাসের সমাধিস্থল

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা সম্ভবত এটাই যে, ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা দিয়েছে! ১৯৫৫-৫৭ সালের মাঝে সাইপ্রাসের বিদ্রোহীদের বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ার ব্রিটিশরা ৩০০০ নিরীহ সাইপ্রিয়টকে হত্যা করে। এই অভিযানে আটকদের বিনা বিচারে দিনের পর দিন আটক রাখা হতো এবং সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের ভয়াবহ নির্যাতন করা হতো। বন্দীদের নিয়মিত প্রহার করা হতো, ওয়াটারবোর্ডে শাস্তি দেয়া হতো ও হত্যা করা হতো। ১৫ বছরের শিশুদের চোখে মরিচের গুঁড়ো মাখিয়ে দেয়া হতো, অন্যদের লোহার তারকাঁটাযুক্ত চাবুক দিয়ে প্রহার করা হতো। যারা বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মী ছিল, তাদের লন্ডনে পাঠানো হতো। পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলের তদন্তে দেখা যায়, এ বন্দীদের পা ভাঙ্গা ও ঘাড়ের কাছে গভীর ক্ষত চিহ্ন। আর এসবই মহান ব্রিটিশ রাজত্বের কৃতিত্ব।

৪। কেনিয়ার ক্যাম্প

১৯৫০ সালে কেনিয়ার অধিবাসীরা স্বাধীনতার দাবী জানালেন। আর এটার জবাব দিল ব্রিটিশরা সাথে সাথেই। দেড় লক্ষ কেনিয়ান আটক হলো ও তাদের নিয়ে যাওয়া হলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। “কাজ কর ও স্বাধীনতা পাও” এই বাণী শুনিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বন্দী ক্যাম্পে ও সেখানে এত কঠোর পরিশ্রম করানো হতো যে বন্দীরা মারা যেত। বন্দী শিবির হয়ে উঠেছিল কবরস্থান। যখন তখন যাকে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। পুরুষদের মলদ্বারে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া হতো, নারীদের স্তন কেটে নেয়া হতো। চোখ উঠিয়ে ফেলা হতো, কান কেটে ফেলা হতো ও দেহের চামড়ায় পেঁচানো তারকাঁটা ঢুকিয়ে দেয়া হতো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় বন্দীদের মুখে কাদা ঢুকানো হত যতক্ষণ না তারা মুখ থেকে কথা বের করে বা মারা যায়। এতকিছুর পরও যারা বেঁচে যেত তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। সরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা ২০০০ বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা ছিল আরো বেশি। ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীন হয়।

৫। বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ

১৯৪৩ সাল। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ ভারতের অধীন পুরো বাংলায় হাহাকার ছড়িয়ে দেয়। ৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় যা কিনা সম্পূর্ণভাবে রোধ করা যেত। অবস্থা আরো ভয়াবহ হয় যখন তৎকালীন অদক্ষ ব্রিটিশ সরকারের পুরো মনোযোগ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ আর তার সাম্রাজ্য বাঁচানোর প্রতি। কিন্তু ২০১০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মধুশ্রী মুখার্জীর “চার্চিল’স ওয়ার সিক্রেট” বইয়ে উঠে আসে যে, দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণসামগ্রীর সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তি একজনই- উইনস্টন চার্চিল।

চার্চিল কোনভাবেই চান নি যে, ব্রিটিশ সেনাদের অতিরিক্ত খাবার-রসদ থেকে সরবরাহ বাংলার মানুষদের দেয়া হোক। এটা হয়তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু তিনি অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে আগত ত্রাণ সামগ্রীবাহী জাহাজ আটকে দেন। এমনকি তিনি ভারতীয়দেরও হাত-পা বেঁধে রেখেছিলেন কিছু করা থেকে। তারা তাদের নিজেদের জাহাজ ব্যবহার করতে পারছিল না বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্য করতেও পারছিল না। একই সময় লন্ডন খাদ্যদ্রব্যের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেয়। ভারতের ব্রিটিশ সরকার যখন লন্ডনে টেলিগ্রাম করে মানুষের মারা যাবার সংবাদ পাঠায়, বলা হয় যে চার্চিল নাকি এসব শুনে বলেছিলেন, “গান্ধী এখনো মরে না কেন?” একজন নেতা যিনি কিনা ২য় মহাযুদ্ধে নাৎসী জার্মানীকে হারিয়ে বীরের খেতাবে ভূষিত, তার হাতেই বহু মানুষের দুর্ভিক্ষে মারা যাবার করুণ ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিন করেছিলেন ইউক্রেনিয়ান গনহত্যায়।

চার্চিল ছিলেন চরম মাত্রায় বর্ণবিদ্বেষী। তার বক্তব্য ছিল, “I hate Indians. They are a beastly people with a beastly religion.”