এনিলিজ মিচেলের মৃত্যুর কারণ- পিশাচ, নাকি অজানা কোনো রোগ?

এনিলিজ মিচেল ছিল বেশ হাসি খুশী এক মেয়ে। ১৯৫২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে তার জন্ম হয়। ধারণা করা হয়, তাকে শয়তান কিংবা পিশাচ ধরেছিল, যে কারণে সিদ্ধান্ত হয় সেটি দূর করার জন্য ‘এক্সোরসিজম” করতে হবে। এক্সোরসিজম হচ্ছে, খ্রিস্টীয় রীতি অনুসারে পিশাচ বা অশুভ আত্মা তাড়ানোর একটি রীতি। এনিলিজের জন্মের চার বছর আগে তার মা অ্যানা মিচেল একটি অবৈধ মেয়ে শিশুর জন্ম দেন। একটি রোমান ক্যাথলিক পরিবারের জন্য এটি ছিল চরম লজ্জার। এরপর অ্যানা মিচেল বিয়ে করেন ও এনিলিজের জন্ম হয়। কিন্তু অ্যানা তার আগের কৃতকর্মের জন্য সব সময় অপরাধবোধে ভুগতেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মেয়েটি আট বছর বয়সে মার যায়। কিন্তু এখানেই ঘটনা শেষ হয়ে যায় নি। এনিলিজ বড় হয়ে সব সময়ই মনে করতে থাকে, তার মায়ের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে। যেকারণে দিনের একটা বড় অংশ সে তার মা, পাপে নিমজ্জিত তরুণ সমাজ আর খারাপ পাদ্রীদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার জন্য প্রার্থনায় লিপ্ত থাকতো। ১৬ বছর বয়সে এনিলিজ যখন হাই-স্কুলের ছাত্রী, তখন তার মাঝে কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়। প্রায়ই তার শরীরে প্রচণ্ড খিঁচুনি দেখা দিত, যেটাকে পরে একজন নিউরোলজিস্ট মৃগীরোগ বলে শনাক্ত করেন। এনিলিজ ওষুধ নিতে শুরু করে ও চেষ্টা করে স্বাভাবিকভাবে জীবনকে গুছিয়ে নিতে। সে স্কুল থেকে কলেজে পদার্পন করে। তার লক্ষ্য ছিল শিক্ষক হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করছিল না, এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। এনিলিজ তার খুব ভালো পারিবারিক বন্ধু থিয়া হেইনের সাথে একবার স্যান ড্যামিয়ানোতে তীর্থস্থান ভ্রমণে গেল। থিয়া প্রায়ই এরকম বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান দেখার জন্য বের হতো। ঘোরার এক পর্যায়ে এনিলিজ ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিমার সামনে দিয়ে হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়ে ও তাকে যখন পবিত্র হ্রদের পান পান করতে বলা হয়, তখন সে অস্বীকৃতি জানায়। এটা থেকে থিয়ার ধারণা হয়, এনিলিজের উপর শয়তান বা পিশাচ ভর করেছে। এনিলিজ ও তার পরিবার সবাই এটাই ভাবলো ও বেশ কয়েকজন পাদ্রীর কাছে গেল সাহায্যের জন্য। যাতে তারা এক্সোরসিজমের মাধ্যমে এনিলিজের উপর ‘ভর করা’ পিশাচকে তাড়িয়ে দেন। কিন্তু পাদ্রীরা এটি করতে অস্বীকৃতি জানান, তারা বলেন এনিলিজের যে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট চলছিল, সেটাই চলতে দেয়া উচিত। আর একান্তই এক্সোরসিজম করতে হলে তার পরিবারকে বিশপের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

এর কিছুদিন পর, আর্নেস্ট অল্ট নামে একজন গ্রাম্য পুরোহিত এনিলিজকে দেখে বলেন, এনিলিজ মৃগীরোগ নয়, অশুভ পিশাচ দ্বারা আক্রান্ত। এবার সবাই বিশপকে এক্সোরসিজম করার অনুমতি দেয়ার জন্য আবেদন করলেন। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশপ জোসেফ স্ট্যাঙ্গল ফাদার রেনজকে এনিলিজের এক্সোরসিজম করার অনুমতি দেন, কিন্তু শর্ত থাকে এটি একদম গোপনে করতে হবে। ২৪ সেপ্টেম্বর, এনিলিজের উপর ভর করা পিশাচ তাড়ানোর প্রথম সেশন বা পর্যায় শুরু হয়। এনিলিজ, তার পরিবার ও যারা পিশাচ দূর করার কাজটি করেছিলেন, সবাই যখন ধরেই নিলেন যে এনিলিজকে পিশাচ ধরেছে, তখন তারা এনিলিজের ওষুধ সেবন করা বন্ধ করে দিলেন। এবার এনিলিজের ভাগ্য পুরোটা চলে গেল এক্সোরসিজমের কাছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে চার ঘণ্টা স্থায়ী এক থেকে দুটি সেশন করে টানা ৬৭ টি এক্সোরসিজম করা হয়, এনিলিজএর উপর ভর করা পিশাচ তাড়ানোর জন্য। একটা সময় এনিলিজ অতিরিক্ত কথা বলতে শুরু করে। সে প্রায়ই বলতে থাকে, সে অধঃপতিত তরুণ সমাজ আর গির্জার ভ্রান্ত পুরোহিতদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মারা যেতে চায়। এনিলিজের অনুরোধে চিকিৎসকরা তার কাছে আসা বন্ধ করে দেন। এনিলিজ ধীরে ধীরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই এনিলিজ যখন মারা যায় তখন ক্রমাগত না খাওয়ার কারণে সৃষ্ট অপুষ্টিকে দায়ী করা হয়। এনিলিজের ওজন নেমে এসেছিল ৩০.৯১ কেজিতে।

এবার স্টেট স্বপ্রণোদিত হয়ে এনিলিজের অভিভাবক ও যে পাদ্রীরা এক্সোরসিজমের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে এনিলিজকে চিকিৎসা না করে অবহেলায় মেরে ফেলার অভিযোগ আনে ও মামলা করা হয়। এনিলিজের দেহ কবর থেকে তোলা হয়, চিকিৎসকরা জানান, এনিলিজ প্রচণ্ড ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আর মৃগীরোগের মাঝে বেড়ে উঠেছিল, যার ফলে সে এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ১৯৭৮ সালের ৩০ মার্চ মামলার শুনানি শুরু হয়। পুরোহিত আর্নেস্ট অল্ট পিশাচ তাড়ানোর এক পর্যায়ে চিকিৎসক রিচার্ড রথকে নিয়ে আসেন, যিনি এনিলিজকে বলেন, “শয়তানের বিরুদ্ধে কোন ইনজেকশন কাজ করতে পারে না, এনিলিজ!” শুধু তাই নয়, এটাও বলা হয়েছিল, এনিলিজের উপর ছয়টি অশুভ আত্মা ভর করেছে, তার মাঝে তিনটি হচ্ছে এডলফ হিটলার, নিরো ও জুডাস ইসকারিওট(যীশুকে যে ধরিয়ে দিয়েছিল)। যেই বিশপ অনুমতি দিয়েছিলেন ও যে পাদ্রীরা এক্সোরসিজম করেছিলেন, আদালত তাদেরকে ৬ মাসের কারাদণ্ড(পরে স্থগিত করা হয়) ও ৩ বছর পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ প্রদান করে। বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগে এনিলিজের পরিবার তার দেহকে কবর থেকে তোলার আবেদন করে এই বলে যে, এনিলিজকে অনেক তাড়াহুড়োর মাঝে কবর দেয়া হয় আর তার কফিনটি ছিল খুব নিম্নমানের। ১৯৭৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এনিলিজের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে এবার ভালভাবে সমাধিস্থ করা হয়। গোল বাঁধল, যখন দখিন ব্যাভারিয়ার এক নান দাবি করলেন, মৃত্যুর দুই বছর পরও এনিলিজের দেহ একদম অক্ষত ছিল আর এর থেকেই বোঝা যায়, তার দেহের ভেতর কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি লুকিয়ে ছিল। অফিসিয়ালভাবে এই বক্তব্য অস্বীকার করা হয়। কিন্তু একই সাথে অভিযুক্ত পাদ্রীরা যখন এনিলিজের দেহাবশেষ দেখতে চাইলেন, তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফাদার রেনজ পরে জানান, তাকে এনিলিজের সমাধিস্থলে ঢুকতেই দেয়া হয় নি। কিন্তু কেন? ২০১৩ সালে এনিলিজ যে বাড়িতে থাকতো, সে বাড়িটিতে দুষ্কৃতিকারীরা আগুন লাগিয়ে দেয়। পুলিশের ধারণা, এনিলিজের ঘটনার সাথে জড়িতদের কেউ এই কাজ করে থাকতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *