মুন ল্যান্ডিং কনস্পিরেসি থিওরি– আমেরিকার চন্দ্র অভিযান ছিল এক সাজানো নাটক!

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার চন্দ্রমিশন এপোলো-১১ চাঁদে তাদের মিশন সম্পন্ন করে ফিরে আসার পর পরই শুরু হয়ে যায় এক চমকপ্রদ এবং দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের। বিতর্কটি হলো, আমেরিকার চাঁদে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারটি আসলে মিথ্যা এবং জনগনকে ধোঁকা দেয়ার এক অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির স্বপক্ষে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিস্তর গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে। তাদের বক্তব্য এপোলো মিশনগুলো পৃথিবীতে মুভি ক্যামেরার মাধ্যমে শ্যুট করা । তারা “নাসা”-কে এই ধোঁকাবাজির মূল হোতা বলে দায়ী করে,কারণ সেই চন্দ্রমিশনগুলোর সাথে জড়িত অনেক প্রমাণ,ছবি, টেলিম্যাট্রিক টেপ হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে বা করা হয়েছে অথবা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নাসা ও কনস্পিরেসি থিওরির প্রবক্তা-এই দুই বিবাদমান দলের বাইরের নিরপেক্ষ অনুসন্ধানকারিদের অনুসন্ধানে অবশ্য মানুষ চাঁদে গিয়েছে-এই দাবীর পক্ষেই প্রমাণ এসেছে। তবুও “মানুষ চাঁদে যায় নি” তত্ত্বটি এখনো বিতর্কের ময়দানে টিকে আছে নাসা’র জন্য এক মাথা ব্যথা হয়ে। বিষয়টি নিয়ে জনমত জরিপ করলে দেখা যায়, ৬-২০% মার্কিনী বিশ্বাস করেন, প্রথম এপোলো মিশনটি ছিল আসলে ভুয়া, রাশিয়াতে এই দলের হার ২৮%। ২০০১ এ জনপ্রিয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফক্স টিভি তাদের Conspiracy Theory: Did We Land on the Moon?-এ দাবি করে , ১৯৬৯ এর এপোলোর ১ম মিশনটা ছিল আসলে ভুয়া, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাশূণ্য প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলার জন্য। বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত হয় ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত বিল কেসিংস এর লেখা বই We Never Went to the Moon: America’s Thirty Billion Dollar Swindle হওয়ার পর। “ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি” নামে এক সংগঠন প্রথম বারের মত নাসাকে অভিযুক্ত করে এই বলে যে,এপোলো-১১ মিশনটি আসলে ওয়াল্ট ডিজনির অর্থায়নে হলিউডে ধারণ করা করা হয়েছে। যার পান্ডুলিপি লিখেছিলেন আর্থার সি ক্লার্ক আর পরিচালনায় ছিলেন স্টেনলি কিউব্রিক। লোকসাহিত্যবিদ লিন্ডা ডে’র মতে,আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত,তখন জনগনের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতেই নাসা’র এই নাটকের মঞ্চায়ন।

চন্দ্রমিশন এপোলো-১১ একটি সাজানো নাটক-এই দাবির সপক্ষে বেশ কিছু তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছে । প্রধান তিনটি হলো—সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাশূন্য প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলার আকাঙ্খা, মার্কিন সরকার আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব চন্দ্র মিশনে আর অর্থ দিতে রাজি হচ্ছিলো না,অর্থ বরাদ্দ যাতে বন্ধ না হয়,তাই নাসা’র এই নাটকের অবতারণা এবং সর্বশেষ ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা। আসুন এই দলের কয়েকজনের যুক্তি শোনা যাক। ব্রিটিশ প্রকাশক মার্কাস এলেন “নেক্সাস” এ লিখেন, ‘নাসা এপোলো-১ মিশনে তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট অগ্নিকান্ড সামাল দিতে পারে নি, তাই তারা পরে রোবট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকৃতপক্ষে,এপোলো-১১ নয়,এপোলো-১৪ ও ১৫ হলো প্রথম চন্দ্রমিশন,যাতে মানুষ চাঁদে পদার্পন করে।‘ মিল্টন উইলিয়াম কুপার নামে একজন দাবি করেন, ‘সব গুলো এপোলো মিশনই আসলে ব্যপক রিহারসেলের মাধ্যমে এক বিশাল সাউন্ড স্টেজে তৈরি করা হয়েছে।‘ ডেভিড গ্রোভস, একজন ফটোগ্রাফ বিশেষজ্ঞ জানান, লুনার ল্যান্ডার থেকে নীল আর্মস্ট্রং এর চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার যে ছবি আছে,তা পরীক্ষা করে তিনি দেখেছেন,”সেখানে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করা হয়েছে।“ বিল কেসিং,যার মাধ্যমে এই বিতর্কের সূত্রপাত,তার মতে- “রাশিয়া সব সময়ই আমেরিকার চন্দ্রাভিযানের কার্যকলাপ চোখে চোখে রাখতো। নাসা’র প্রয়োজন ছিল,একটি প্রতারণামূলক কিন্তু সবার দৃষ্টিতে সফল চন্দ্রমিশনের নাটক মঞ্চায়িত করা। ইতোমধ্যেই ১৯৫৯ এ সোভিয়েত নভোচারি ইউরি গ্যাগারিনের মহাশূণ্য ভ্রমণের ব্যপারটি আমেরিকার জন্য অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সেই সময়ে চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে মিশন সফল করার সম্ভাব্যতা হার ছিল ০ দশমিক ০০১৭% ।”

স্ট্যানিস্লাভ পোক্রোভস্কি (General Director of a scientific-manufacturing enterprise Project-D-MSK ) ক্যালকুলেট করে দেখান যে, নাসা থেকে “স্যাটার্ন ভি” রকেটের উড্ডয়নকালীন যে গতিবেগ জানানো হয়েছে তা প্রকৃত গতির তুলনায় অর্ধেক। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি জানান, “বর্তমান (সেসময়ের) বিশ্বের সাম্প্রতিক টেকনোলজি, রকেটের গতিবেগ, মহাশূন্যতে বায়ুস্তরের স্বল্প ঘনত্ব শুধু চাঁদের চারপাশে মহাশূন্যযানের প্রদক্ষিণকে সম্ভব করতে পারে, নাসা যা দাবি করেছে তা নয়।“ বার্ট সিব্রেল, একজন চলচ্চিত্র পরিচালক A Funny Thing Happened on the Way to the Moon ( ২০০১) যিনি বিশ্বাস করতেন এপোলো-১১ চন্দ্রমিশন সত্য নয়, সেই মিশনের তিন নভোচারীর একজন বাজ অলড্রিনকে মুখোমুখি এক সাক্ষাতকারে এই বিষয়ে কথা বলতে চাইলে, অল্ড্রিন তার মুখে ঘুষি মারেন (সেপ্টেম্বর ৯,২০০২) । লস এঞ্জেলেস কাউন্টি ডিস্ট্রিক এটর্নি অফিস,অল্ড্রিনের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। নাসা মিডিয়ার কাছে যেসব ছবি সরবরাহ করে তা নিয়ে বিতর্ক যেন শেষ হবার নয়,উভয় পক্ষেরই যুক্তি-পাল্টা যুক্তি এখনো চলমান। ছবিগুলোতে আলোক-প্রক্ষেপণ,নভোচারীদের ছায়া,ব্যাকগ্রাউন্ড,আমেরিকার পতাকার রঙ কিংবা একেক ছবিতে একেক রকম অবস্থান-এই অর্ধ শতাব্দীকালব্যাপী বিতর্ককে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। এপোলো-১১ তে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর প্রাথমিক নকশা,ব্লু-প্রিন্ট, ডাটা টেপ ও প্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠের হাঁটার হাই-ডেফিনেশন ভিডিওর হারিয়ে যাওয়া-ঘটনার জল ঘোলা করেছে শুধু। ২০০৯ এ নাসা জানায়,তারা বহু আগেই টেপ গুলোতে থাকা তথ্য মুছে দিয়েছে,যাতে সেগুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই যুক্তি অনেকের কাছেই হাস্যকর লাগে,নাসার কি অর্থের এতই অভাব পড়ে গেলো যে আমেরিকার “জাতীয় গৌরবময়” অধ্যায়ের একটি ঘটনার স্মৃতি তারা এভাবে মুছে দেবে!

সর্বশেষ ফক্স টিভির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরো কিছু ভয়াবহ তথ্য। নাসা’র মানুষ্যবাহী চন্দ্রমিশনের সাথে জড়িতদের মধ্যে দশ নভোচারী ও আরো দুইজনের মৃত্যু হয় অস্বাভাবিকভাবে। থিওডোর ফ্রিম্যান টি-৩৮ বিমান থেকে পড়ে মারা যান (১৯৬৪), এলিওট সি ও চার্লি ব্যাসেট-টি-৩৮ বিমান ক্র্যাশ(১৯৬৬), ভার্জিল ইভান গাস গ্রিসম-এডওয়ার্ড হিগিনস-রজার বি চেফ- এপোলো-১ অগ্নিকান্ড( জানুয়ারি,১৯৬৭) ,এডওয়ার্ড এড গিভেন্স-গাড়ি দুর্ঘটনা (জুন,১৯৬৭) ,রবার্ট হেনরি লরেন্স ইউএস এয়ার ফোর্সের Manned Orbiting Laboratory র পাইলট হিসেবে নির্বাচিত হবার অল্প কিছুদিন পরই F-104 বিমান ক্র্যাশে মারা যান (ডিসেম্বর,১৯৬৭) । এছাড়া ১৯৬৭র ২৭ এপ্রিল থমাস রোনাল্ড ব্যারন নামে নর্থ আমেরিকা এভিয়েশনের এক কর্মচারী সপরিবারে এক কার-ক্র্যাশে নিহত হন। তিনি ছিলেন এপোলো-১ মিশনের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর এবং এপোলো-১ অগ্নিকান্ডের পর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে খোলাখুলি সমালোচনায় করায় অগ্নিকান্ডের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি তাকে চাকরিচ্যুত করে,এর ৬ দিনের মাথায় তিনি নিহত হন। সর্বশেষ নাসা’র জনসংযোগ ও মিডিয়া সার্ভিসের একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা ব্রায়ান ডি ওয়েলচ ফক্স টিভির ডকুমেন্টারির যুক্তি খন্ডন করে নাসা’র পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার কয়েক মাস পরেই হার্ট এটাকে মারা যান,মাত্র ৪২ বছর বয়সে। দাবি করা হয়,হার্ট অ্যাটাক স্বাভাবিক ছিল না। হয়তো ব্যাপক মানসিক চাপ কিংবা কোন অজানা রাসায়নিক পদার্থ তার শরীরে পুশ করা হয়,তাতেই তিনি মারা যান। যদিও তিনি চন্দ্রাভিযানের সত্যতার পক্ষেই যুক্তি দিয়ে গিয়েছেন,তবে কিছু সূত্র জানায়,অনেকে তার কাছ থেকে গোপন তথ্য ফাঁসের ভয়ে ছিল। এই বিতর্কের শেষ কোথায়,তা সময়ই বলে দেবে হয়তো ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *