বিখ্যাত আঁকিয়ের আজকের পর্বে আমরা কথা বলবো একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর সাথে! জিনি কিনা গত ৩ যুগেরো বেশী সময় ধরে বিশ্ব বিখ্যাত ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার জন্য কার্টুন একে যাচ্ছেন! তার কার্টুন নিউইয়র্ক টাইমস আর ওয়াশিংটন পোস্ট এর মতো আরো শতাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে! তিনি আর কেউ নন তিনি হচ্ছে ক্যাল নামেই বহুল পরিচিত কার্টুনিস্ট কেভিন ক্যালাগার!
দেখুন ইংরেজি সাক্ষাৎকারকটি ইউটিউবে।
ক্যালঃ তোমাকে দেখে খুবই ভাল লাগছে বন্ধু, এ শো’তে উপস্থিত হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
তন্ময়ঃ আপনি কেমন আছেন, মিস্টার কেভিন?
ক্যালঃ আমি খুবই ভাল আছি। তুমি জানো আমাদের চারপাশের পৃথিবী ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যার মানে,কার্টুন আঁকার জন্যও সময়টা খুব ভাল।
তন্ময়ঃ ক্যাল, আপনার কাছে আমার প্রথম প্রশ্নটি হলো, কত বছর ধরে আপনি “দ্য ইকোনোমিস্ট” ম্যাগাজিনের জন্য কার্টুন আঁকছেন?
ক্যালঃ আমি শুরু করেছিলাম বেশ তরুণ বয়সে, ১৯৭৮ সালে। সেভাবে হিসাব করলে বলা যায়, প্রায় ৪৪ বছর ধরে আঁকছি। বেশ দীর্ঘ একটা সময় ধরে প্রচুর কার্টুন এঁকেছি।
তন্ময়ঃ আপনি এ দীর্ঘ সময়ে আনুমানিক কতগুলো কার্টুন এঁকেছেন?
ক্যালঃ আমার মনে হয়, আমার প্রকাশিত কার্টুনের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার।অবশ্য এর বাইরেও আমি বন্ধুদের জন্য বহু কার্টুন এঁকেছি বা এরকম কার্টুনও প্রচুর আছে, যা কোথাও প্রকাশিত হয় নি। আমি দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর কার্টুন আঁকছি। এটা একই সাথে বেশ মজার অভিজ্ঞতা।
তন্ময়ঃ এডিটোরিয়াল বা সম্পাদকীয় কার্টুনিস্ট হিসেবে আপনার কাজ করার অভিজ্ঞতাটা কেমন? রাজনৈতিক স্যাটায়ার কার্টুন আঁকতে আপনাকে কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে?
ক্যালঃ তুমি জানো সব ধরণের কার্টুনের মাঝে সম্পাদকীয় কার্টুনের বিশেষ একটা স্থান রয়েছে। এখানে আমরা চেষ্টা করি, কার্টুনের মাধ্যমে পৃথিবীকে আরেকটু ভালো, আরেকটু সুন্দর বানিয়ে তুলতে। কার্টুনে রম্য ও ছবি ব্যাবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশের জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে তুলে ধরতে পারি।
এটা করতে পারা আমার জন্য এক বিশাল তৃপ্তির বিষয়। কারণ দেখ কার্টুনের মাধ্যমে যে তুমি শুধু নিজের বা নিজের পরিবারের জীবনে প্রভাব ফেলতে পার তা নয়, বরং সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই কার্টুনের একটা আবেদন রয়েছে। আর এছাড়াও, একবার শুধু চিন্তা কর, তুমি যদি শুধু আঁকাআঁকি করে জীবন চালাতে পারো, এর চেয়ে দারুণ ব্যপার আর কী হতে পারে!
তন্ময়ঃ আমি আপনার আঁকা “দ্য ইকোনমিস্ট” ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। একটা সম্পূর্ণ প্রচ্ছদ আঁকতে আপনার কতটুকু সময় লাগে? আজ পর্যন্ত আপনি কতগুলো প্রচ্ছদ এঁকেছেন?
কালঃ প্রচ্ছদ একটি ম্যাগাজিনের খুবই গুরত্বপূর্ণ অংশ। এটা একটা ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকীয় কেই উপস্থাপন করে, যেটাকে ইকোনোমিস্ট পত্রিকা্য “লিডার” বলা হয়ে থাকে। আমি “ইকোনোমিস্ট” ম্যাগাজিন ও অন্যান্য প্রকাশনীর জন্য ১৫০ টির মতো প্রচ্ছদ এঁকেছি।
সাধারণত তারা সোমবার দুপুরে আমাকে কল দেয়। আর আমাকে বুধবার দুপুরের মাঝে কার্টুনটি প্রস্তুত করে দিতে হয়। তাই বলা যায়, সব মিলিয়ে ২ দিন সময় প্রয়োজন হতো পুরো কাজটি শেষ করতে। এই পুরো সময়টা জুড়েই আমাকে প্রচুর কাজ করতে হয়। আমি আমেরিকার বাল্টিমোর শহরে, আমার বাসায় বসে প্রাথমিক পর্যায়ের স্কেচগুলো আঁকার কাজটা করি।
এরপর সেগুলো লণ্ডনে পাঠাই, যাতে “দ্য ইকোনোমিস্ট” ম্যাগাজিনের কর্মীরা তাদের মতামত জানাতে পারে। এরকম বেশ কয়েকবারই রাফ স্কেচগুলো সম্পাদনা করতে হয়, যতক্ষণ না চুড়ান্ত স্কেচ আঁকা হচ্ছে। আমেরিকাতে বাল্টিমোরে যখন মঙ্গলবার বিকেল, তখন লণ্ডনে থাকা আমার সহকর্মীরা ততক্ষণে ঘুমোতে চলে যায়, কারণ তাদের সাথে আমার স্থানীয় সময়ের ব্যবধান ৫ ঘন্টা। ফলে এ সময়টাতেই আমাকে একাই পুরো আর্টওয়ার্কটি চূড়ান্ত করে ফেলতে হয়, যেন তারা পরের দিন সকালে সেটি হাতে পেয়ে যায়।
তন্ময়ঃ আমাদের আজকের পর্বে আমরা ক্যারিকেচার ও কিভাবে একটি ক্যারিকেচার একজন মানুষের ভেতরের বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়ে তুলে, এসব নিয়ে কথা বলছি। আমরা আপনার কার্টুনগুলোতেও এ ব্যপারটা প্রচুর দেখতে পাই। আপনি কিভাবে ক্যারিক্যাচারের মাধ্যমে মানুষের ভেতরের বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়ে তুলেন, তা বলবেন কি?
ক্যালঃ তুমি জানো, ক্যারিকেচার আঁকার ব্যপারটা বেশ ট্রিকি একটা ব্যপার। কিছুক্ষেত্রে ক্যারিকেচার একজন মানুষের সতন্ত্র স্বত্বটা কে ফুটিয়ে তোলে, আবার কিছু ক্যারিকেচারে শুধু একজন ব্যক্তির সিম্বল আকারে কাজ করে। এরকম একজনের সিম্বল বা বর্ননা চিত্র হিসাবে ক্যারিকেচার বেশ দ্রুত এঁকে ফেলা যায়, আর সেগুলো ক্যারিকেচার হিসেবেও ঠিকঠাক। তবে তুমি যদি কোনো মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো খুব গভীরভাবে বুঝতে পারো, তাহলে ক্যারিকেচার আঁকার ক্ষেত্রে সেটা আসলেই খুব কাজে দেবে।
আমরা এটা সবাই জানি। যেমন ধর যখন কেউ অন্য কোন ব্যাক্তির অভিব্যক্তি হুবহু নকল করে দেখাতে পারে তখন সেটা ভালো হলে কিন্তু আমরা সবাই বুঝি যে সে আসলেই হুবহু সেই ব্যক্তির মত করে অভিনয় করছে।
একই ব্যপার ক্যারিকেচার আঁকার ক্ষেত্রেও ঘটে। তুমি যে ক্যারেক্টারকে আঁকছো, ক্যারিক্যাচারে তার বিশিষ্ট গুলো যদি খুবই শক্তিশালী হয়, তাহলে সবাই সেটা দেখলেই সবাই সহজে বুঝতে পারবে আর এটা তোমার কার্টুনের ম্যাসেজ পরিষ্কার ভাবে দিতেও সাহায্য করবে।
আমি সব সময় চেষ্টা করি, আমার সেরা ক্যারিকেচারটা আঁকার। আমি শুরুতে জানি না, তা আদৌ হবে কিনা, কিন্তু আমি চেষ্টা করি। যখন তুমি ক্যারিকেচার ভালোভাবে আঁকা শিখতে চাও সেখত্রে অবশ্যই আমাদের চেহারার বিভিন্ন অংশ কিভাবে কাজ করে; মুখের হাড় বা মাংসপেশীগুলোর অবস্থান ইত্যাদী জানাটা জরুরী। বিশেষ করে, তুমি যার ক্যারিকেচার আঁকবে তার মুখের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করতে হবে।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য আঁকা ও একজন মানুষের সতন্ত্র স্বত্বা/স্বভাব বা চরিত্রগত দিকগুলো আঁকার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ধরা যাক, তোমার কোনো বন্ধুর সাথে তোমার দেখা হলো, যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার চেহারা কিন্তু তুমি তাকে সব সময় যেমনটা দেখেছ, তেমনই আছে- একই মুখ বা মুখের পেশীগুলো। কিন্তু তুমি তার মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পেলে যে, যা দেখে মনে হবে তোমার বন্ধুটি অসুস্থ। আবার এ বন্ধুটিই যখন আনন্দিত অবস্থায় থাকে, তখন তুমি তার সেই একই চেহারায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে দেখবে, যা থেকে বোঝা যাবে সে তখন খুশি। তাই আমরা বলতে পারি, ক্যারিকেচার হচ্ছে মানুষের মুখের আড়ালে যে স্বভাব বা অনুভূতি আছে, তা তুলে ধরা। এটা কিছুটা কঠিন কিন্তু তুমি যদি এ বৈশিষ্ট্যগুলো কারো চেহারায় খুঁজতে থাকো, অবশ্যই তা খুঁজে পাবে।
২য় যে ব্যপারটা আছে, সেটা তোমার আর আমার মত যারা রাজনৈতিক ক্যারিকেচার আঁকি, তাদের জন্য। আমরা ক্যারিকেচারকে অনেকটা অস্ত্রের মত ব্যবহার করি।যাখন আমরা যখন ক্যারাকটার টাকে আঁকছি তখন তাদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করি, কার্টুনের ম্যাসেজটাকে আরো উপযুক্ত করে তোলার জন্য।
তন্ময়ঃ আপনার ক্যারিকেচারের ক্যারেক্টারগুলোর এক্সপ্রেশনগুলো একইসাথে খুব মজার ও নিখুঁত হয়। এটা কিভাবে সম্ভব?
ক্যালঃ এটার উদাহরণ হিসেবে, আমি জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প- এ দুইজনকে নিয়ে বলতে পারি। তারা দুজনই তাকানোর সময় একইভাবে চোখ কুঁচকে রাখেন। কিন্তু আমি যখন এদের দুজনকে আঁকি, তাদের জন্য আমার মাথায় দুটি আলাদা অনুভূতি কাজ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখলেই মনে হয়, তিনি সব সময়ই রেগে আছেন, কিছু না কিছু নিয়ে সব সময়ই তিনি বিরক্ত। তিনি চোখ কুঁচকে তাকান, কিন্তু তার তাকানোটা দেখে মনে হবে তিনি কিছু একটা নিয়ে অসম্ভব বিরক্ত।
জো বাইডেন- তিনিও চোখ কুঁচকে তাকান। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হবে, তিনি সারাক্ষণই সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন বা রোদের মাঝে চোখ পিটপিট করছেন। এরা দুজনেই চোখ কুঁচকে তাকান, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তাদের মাঝে পার্থক্য ধরা পড়ে। একই রকম তাকানোর ভঙ্গিমার পরেও, এদের দুইজনকে নিয়ে আমাদের মনে দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়।
তন্ময়ঃ পরের প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত আপনি আমেরিকার কতজন প্রেসিডেন্টের ক্যারিকেচার এঁকেছেন?
ক্যালঃ আমার মনে হয়, আট জন। আট জন প্রেসিডেন্টের মাঝে, আমি প্রথম আঁকি জিমি কার্টারের ক্যারিকেচার। এরপর আঁকি রোনাল্ড রিগ্যানকে; এরপর জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ; তারপর বিল ক্লিনটন; তারপর জর্জ ডব্লিউ বুশ, এরপর আঁকি বারাক ওবামা, এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর এখন জো বাইডেন।
তন্ময়ঃ এঁদের মাঝে কার ক্যারিকেচার এঁকে আপনি সবচেয়ে বেশ মজা পেয়েছেন এবং কেন?
ক্যালঃ
আমি সবসময়, সবচেয়ে বেশী আনন্দ পাই, যখন যে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকেন, তার ক্যারিকেচার এঁকে। কারণ, আমি তাদের মুখের ভঙ্গিমা বা চেহারার পরিবর্তন দেখে সব সময়ই কিছু না কিছু শিখি। কারণ, যখন তারা প্রেসিডেন্ট হন, তাদের চেহারা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যেতে থাকে। তুমি খেয়াল করলে অবাক হবে, তারা যেন খুব দ্রুত বুড়ো হয়ে যান। এবং প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব মোটেও সহজ নয়, ভীষণ মানসিক চাপ থাকে এতে।
আমি কখনোই প্রেসিডেন্ট হতে চাই না। যদি তোমাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়, পরের ২ বছরে তোমার চেহারায় আমার মতো বুড়ো বুড়ো ভাব চলে আসবে। এরকমটাই হবে। এটা খুবই কঠিন কাজ”। (হাসি)
তবে একজন মানুষের ক্যারিকেচার আঁকতে আমার বেশ ইন্টরেস্টিং লাগতো, তিনি হচ্ছেন রোনাল্ড রিগ্যান। এটা বেশ আগের কথা, যখন আমি মাত্রই কার্টুনিস্ট হিসেবে আমার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট হবার আগে হলিউডের অভিনেতা ছিলেন, তার মুখের অভিব্যক্তিগুলো ছিল খুবই সাবলীল। তাঁর মুখে সব রকমের অভিব্যক্তিই ফুটে উঠতো, যেগুলো কার্টুন বা ক্যারিকেচার আঁকার সময় আমরা কার্টুনিস্টরা একটা মানুষের মুখে খুঁজে থাকি।
অন্যদিকে, সেসময় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। তার মুখে শুধুমাত্র একই ধরণের এক্সপ্রেশন বা অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত। তার চেহারা ছিল একদম সলিড ও স্ট্রেইট, এছাড়া তাঁর ক্যারিকেচার আঁকার সময় সবাই তাঁর নাকটিকে তীক্ষ্ণ ও সরু করে আঁকতো। কিন্তু আসলে কিন্তু তার এরকম নাক ছিল না। আসলে তার কপাল সামনের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছিল, আর থুতনির নিচের চামড়া এমনভাবে আঁকা হতো, যেন সেটা নাকের সাথে গিয়ে মিশেছে। এর ফলে ক্যারিকেচারে তাঁর চেহারা বা মুখের আকৃতি তীরের মতো তীক্ষ্ণ ও সূঁচালো দেখাতো। এই জন্যই সূঁচালো করে আঁকাটাই সাধারন ছিল।
তন্ময়ঃ কার্টুনিস্ট হিসেবে আপনার এই দারুণ ও দীর্ঘ পথচলা থেকে একটা গল্প আমাদেরকে শোনান।
ক্যালঃ আমার মনে হয়, আমরাই প্রথম প্রজন্ম যারা তথ্য আদান প্রদানের জন্য ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু করি, সেটা ৮০-র দশকের শেষের দিকে। তখন এটা বেশ কঠিন কাজই ছিল। তখনকার সময়ে একটা সাদাকালো ছবি, যেটার সাইজ আজকের একটা ইমেইলের সমান হবে হয়তো, সেটা পাঠাতেও ৩ ঘন্টা সময় লেগে যেত। ছবির সাইজ যত বড় হতো, ওয়েবে সেটা পাঠাতেও তত বেশি সময় লাগতো। কখনো কখনো প্রচ্ছদ বা অন্যান্য ইমেজ ফাইলের সাইজ এত বড় হয়ে যেত যে, তখনের ইন্টারনেট স্পিড দিয়ে তা পাঠানো সম্ভবই ছিল না। সেজন্য আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে বিমানে করে আর্টওয়ার্ক পাঠানোর জন্য আমাদের কাউকে নিয়োগ দিতে হতো।
একবার কোনো এক সপ্তাহে আমার একটা কার্টুন এভাবে পাঠাতে গিয়ে এয়ারপোর্টে ট্রানজিটের সময় হারিয়ে যায়। সবার মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা! লন্ডন অফিসের ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কি করা যায়। আমি বললাম, আমার কাছে হারিয়ে যাওয়া আর্টওয়ার্কের সাদা-কালো ভার্সনটা আছে, কালার ভার্সনটা নেই। আমি তাদেরকে সেটাই ফ্যাক্সের মাধ্যমে পাঠালাম। সেসময় ফ্যাক্সে ছবি পাঠালে এখনকার মতো এত হাই রেজোলিউশনের ছবি পাওয়া যেত না। এরপর লন্ডন অফিসের ওরা সেটা ফ্যাক্স থেকে বের করে প্রিন্ট করলো, ও সাদাকালো ছবির উপর রঙ স্প্রে করে দিল। এরপর সেটা ম্যাগাজিনের কাভারে দেয়া ছিল। এটা দেখতে ছিল একবারে যাচ্ছেতাই।
তাই তারা আমাকে পরের সপ্তাহে কল দিয়ে বলো, “দেখ, এরকম বিড়ম্বনা যেন আর না ঘটে, সেটা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ভবিষ্যতে যখন আমরা আপনাকে আমাদের ম্যাগাজিনের কাভার করতে বলবো; আমরা নিজেরাই আপনার কোনো এক বন্ধুকে টাকা দেবো আপনার আর্টওয়ার্কটি বিমানে করে আমেরিকা থেকে লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য। আমি আর্টওয়ার্ক তৈরি করে নিজের হাতে তা প্যাক করতাম, এরপর কোনো বন্ধু তা লন্ডনে পৌঁছে দিত। হুট করে আমার অনেক অনেক বন্ধু হয়ে গেলো। হাহা!
তন্ময়ঃ আজকের এই শো যারা দেখছে, তাদের মাঝে কেউ যদি কার্টুনিস্ট বা ক্যারিকেচার আর্টিস্ট হতে চায়; তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি থাকবে?
ক্যালঃ প্রথম যে ব্যপারটা, আমরা জানি কার্টুন আঁকা শেখার জন্য খুব বেশি প্রতিষ্ঠান নেই, কিছু আছে; প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কার্টুন আঁকার জন্য আগে যারা কার্টুন এঁকেছেন, তাদের কাজগুলো দেখে দেখে শিখতে হবে। এভাবে আমিও শিখেছি। তাদের থেকে শিখবে, যাদের কাজ তুমি পছন্দ কর। আর এখন ইন্টারনেটের সাহায্যে তুমি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো কার্টুনিস্টের যেকোনো স্টাইল ও এপ্রোচের কাজ দেখতে পাবে। তাই তোমার কাজ হচ্ছে, সেসব কার্টুনিস্টদের কাজ সম্পর্কে জানা। এরপর আঁকতে বসে যাওয়া। তোমাকে প্রচুর আঁকতে হবে। তোমার হয়তো আঁকতে ভাল লাগে, কিন্তু শুরুতে তোমার মাঝে হতাশা চলে আসতে পারে। কারণ, তুমি যেমনভাবে আঁকতে চাইছো, সেভাবে হয়তো হচ্ছে না। কিন্তু তোমাকে আঁকাআঁকি চালিয়ে যেতে হবে।
এরপরের কাজটা একটু কঠিন। তুমি যেটা আঁকলে, সেটা মানুষকে দেখাও। শুরুতে অন্যদের মতামত নেয়াটা বিরক্তি ও দুঃখের কারণ হতে পারে। কিন্তু তুমি যখন কারো কাছ থেকে তোমার আর্টওয়ার্ক নিয়ে মতামত পাবে, তুমি চেষ্টা করবে সেসব মতামত নিয়ে চিন্তা করে কিভাবে আরো ভাল করে আঁকা যায়।
২য় যে কথাটি বলতে চাই, পলিটিক্যাল বা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে, সারা বিশ্বে কখন কোথায় কি হচ্ছে তা সম্পর্কে তোমার ধারণা থাকতে হবে। তুমি টিভি নিউজ, রেডিও বা সংবাদপত্র পড়ে কোনো একটা বিষয়ের উপর ধারণা নিলে। এরপর তুমি সেটার উপর নিজের আইডিয়া প্রয়োগ করে বিষয়টির পক্ষে বা বিপক্ষে কার্টুন এঁকে তোমার মতামত জানাতে পারো।
আরেকটা ব্যপার, আমরা খুব দ্রুত ভবিষ্যতের সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সে সময়, আরো অনেক বেশি স্যাটায়ার, আরো বেশি কার্টুন তৈরি হবার সাথে কার্টুন সংক্রান্ত ক্যারিয়ার গড়ারও সুযোগ বেড়ে যাবে, বিশেষ করে এনিমেশনের জগতে। কেউ যদি এনিমেশন সম্পর্কিত গ্রুপ বা ফোরামগুলোতে বিভিন্ন এনিমেটরের সাথে পরিচিত হয়, এনিমেশনের বিভিন্ন সফটওয়্যারের ব্যবহার শেখে, তাহলে ভবিষ্যত ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে তা সহায়তা করবে।
তন্ময়ঃ আমার মনে পড়ে, ২০১৪ সালে বাল্টিমোরে যখন আপনার সাথে দেখা হয়। তখন আমরা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে একজন কার্টুনিস্টের দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছিলাম। আচ্ছা, একটা কার্টুনের দায়বদ্ধতা কি শুধু কার্টুনিস্টের উপর নির্ভর করে; নাকি এটা একই সাথে দর্শকেরও দায়িত্ব, যারা কার্টুনটি দেখেন ও অনেক সময় নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা দাঁড় করান?
ক্যালঃ তুমি তো জানো, কার্টুনটা আসলে মানুষের সাথে যোগাযোগ করার একটা মাধ্যম। ঠিক যেমন এই মূহুর্তে তুমি ও আমি কথা বলছি, একইভাবে কার্টুনের মাধ্যমে আমরা অন্যদের সাথে কথা বলি। এটা সত্যি, যখন আমি রাজনৈতিক কার্টুন আঁকি, প্রত্যেকটি কার্টুনই কাউকে না কাউকে রাগিয়ে দিয়েছে। তবে অল্প কয়েকজনকে রাগানো বা কিছু সংখ্যক মানুষকে রাগানোর সাথে বিশাল সংখ্যক মানুষকে কার্টুন এঁকে রাগিয়ে দেয়ার মাঝে পার্থক্য তো আছেই।
আবার অনেকে হয়তো আমাদের কাজ আবার পছন্দও করে। কখনো কখনো হয়তো কোনো বিষয়ে কার্টুনিস্টের মতামতটা ভুল, আবার কখনো কখনো দর্শকরাও একটি কার্টুনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
সব কার্টুনিস্ট ও নতুনদেরও কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে এই দুটি প্রধান দিক সম্পর্কে বুঝতে হবে। একটি হচ্ছে, একদল কার্টুনিস্ট যারা মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য, হাসানোর জন্য মজার মজার কার্টুন আঁকে, সেটা দারুণ ব্যপার।
কিন্তু যখন তুমি স্যাটায়ার বা বিদ্রূপাত্মক কার্টুন আঁকবে, যেটা হয়তো হাস্যরসাত্মক কিন্তু একইসাথে যেটায় একটা মতামত আছে, তখন কার্টুন আঁকাটা বিপজ্জনক হতে পারে। ব্যপারটা অনেকটা মানুষের পায়ে পা দিয়ে তাদেরকে রাগিয়ে দেয়ার মতো।
বিশ্বের অনেক জায়গাতেই এজন্য অনেক কার্টুনিস্টকে মারাত্মক বিপদে পড়তে হয়েছে। তাই তোমাদেরকে মনে রাখতে হবে, স্যাটায়ার কার্টুন হচ্ছে অনেকটা শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেডের মত। তোমাকে এটা খুব সাবধানে ব্যবহার করা জানতে হবে, নয়তো এটা তোমার মুখের উপরই বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে। তাই এটা ছুঁড়ে মারার আগে নিশ্চিত হতে হবে, তোমার লক্ষ্যবস্তুতে যেন এটা সঠিকভাবে আঘাত হানে, ঠিক যেভাবে তুমি চাইছো।
তন্ময়ঃ এবার আপনার জন্য একটু সহজ প্রশ্ন। এত বছর কার্টুন আঁকার পর আপনার অনুভূতি কি?
ক্যালঃ প্রথমেই আমি মনে করি, কার্টুন আঁকতে পারা খুব দারুণ একটি ব্যপার। আর্টের এই মাধ্যমটির সাহায্যেই তুমি-আমি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের বার্তাটি পৌঁছে দিতে পারি। মানুষ কার্টুন দেখেই বুঝতে পারে কার্টুনিস্ট কি বলতে চাইছে। আমি চাইলেই কার্টুনের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো মানুষের চিন্তা ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত হয়ে যেতে পারছি। ব্যপারটা খুব দারুণ, তাই না! এছাড়া কত কার্টুন কত মানুষকে আনন্দ দেয়, হাসায়। মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে কার্টুনের মতো দারুণ উপহার আর কিছু নেই! এটা ম্যাজিকের মতোই কাজ করে।
আরেকটা মজার ব্যপার আমি আবিষ্কার করেছি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সময়। ধর, তুমি এয়ারপোর্টে গেলে, তোমার পাসপোর্ট দেখালে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তোমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার পেশা কি?” তুমি বললে, “আমি কার্টুনিস্ট”। এটা শুনেই তাদের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বলে, “আরে তাই নাকি! আমি এর আগে কোনো কার্টুনিস্টকে সামনা সামনি দেখি নি!” হঠাৎ করেই তুমি বুঝবে, কার্টুন ব্যপারটা আসলেই খুব বিশেষ কিছু। এবং এটি একটি অনন্য ব্যাপার!
যখন তুমি অন্য কার্টুনিস্টদের সাথে থাকবে, তখন হয়তো তাদের মাঝে তোমার নিজেকে খুবই সাধারন মনে হবে কিন্তু সারা পৃথিবীর কাছেই, কার্টুন ব্যপারটা একটা স্পেশাল ব্যাপার।আর নিজেকে কার্টুনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে আমি সব সময়ই আনন্দিত ও সম্মানিত অনূভব করি।
তন্ময়ঃ তো সব টিভি অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের সাধারণত উপহার দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের যেহেতু কার্টুন শো, সেহেতু আমাদের অনুষ্ঠানটা শেষ হয় একটু ভিন্নভাবে। উলটো অতিথিদের কাছ থেকে উপহার নিয়ে। তাহলে ক্যাল, আপনি আজ আমাকে কি উপহার দেবেন?
ক্যালঃ বাহ! এটা খুব দারুণ একটা আইডিয়া। তোমার আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি কি তোমার একটা কুইক ক্যারিকেচার আঁকবো?
তন্ময়ঃ সেটা তো খুব দারুণ একটা ব্যপার হবে!
ক্যালঃ বলো ত, কেমন আঁকলাম?
তন্ময়ঃ দুর্দান্ত। এক কথায় অসাধারণ! আমার অনেকদিনের ইচ্ছেটা আজ পূরণ হলো। ক্যাল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার আঁকা, সময় ও জ্ঞান আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। আশা করি, বাংলাদেশের কার্টুনিস্টরা আপনার কাছ থেকে সামনের দিনগুলোতে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে।
ক্যালঃ ভালো থেকো, দেখা হবে!
অনুবাদঃ জুলকারনাইন মেহেদী
সম্পাদনাঃ সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়
লেখাটি কার্টুন পিপল এর মিডিয়াম পেইজে প্রকাশিত। লিংক এখানে।