আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ও ভারমন্ট সীমান্তে ১০৯ মাইল লম্বা এক কুখ্যাত লেক বা হ্রদ আছে। আর এটির নাম হচ্ছে লেক চ্যামপ্লেইন। হ্রদটি কুখ্যাত কারণ গত দুইশ বছর ধরে এই ধারণা প্রচলিত আছে যে এই হ্রদে কোন এক রহস্যময় প্রাণী কিংবা ‘দানব’ আছে। আর এই দানবকে আবার সংক্ষেপে অনেকে ডাকেন ‘চ্যাম্প’ বলে! এই দানবের কথা প্রথম শোনা যায় ১৮১৯ সালে নিউ ইয়োর্কের কাছে পোর্ট হেনরিতে বসতি স্থাপনকারীদের কাছ থেকে। এরপর ১৮৭৩ সালে নিউ ইয়র্ক-এর ড্রেসডেনে একজন রেলওয়ে কর্মচারী দাবি করেন, “সাপের মত বিশাল এক জীবের মাথা পানি থেকে অনেক উপরে ভেসে উঠলো ও হ্রদের অন্যদিক থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।“ এটার পর পরই স্থানীয় কৃষকরা তাদের গৃহপালিত প্রাণী উধাও হয়ে যাওয়ার সমস্যায় পড়লেন। আর এই হ্রদের তীরের কাদামাটির উপর কিছু একটা টেনে-হিঁচড়ে পানির দিকে নিয়ে যাবার দাগ বা চিহ্ন পাওয়া যেত। একই বছর পি টি বারনাম নামে এক ব্যক্তি যে এই দানবকে ধরতে পারবে তাকে ৫০হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা প্রদান করবেন বলে ঘোষণা দেন।
যদিও কেউ সফল হয় নি, কিন্তু রহস্যময় সেই প্রাণী বা দানবের দেখা এরপর অনেকেই পেয়েছেন বলে দাবী করেছেন। ১৮৮৩ সালে ক্লিনটন কাউন্টি শেরিফ নাথান মুনি জানান, তিনি হ্রদের পানিতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট লম্বা সাপ কিংবা এ জাতীয় কোন প্রাণীর দেখা পেয়েছেন। যেটা পানি থেকে প্রায় ৫ ফুট উপরে এর ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল। ১৮৯৯ সালে একদল জেলে আবারো এই প্রাণীর দেখা পায়, যেটি তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সাম্প্রতিককালে চ্যামপ্লেইন হ্রদের দানব কিংবা প্রাণী দেখার সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৯৭৭ সালে। সান্দ্রা ম্যানসি ও তার স্বামী যখন ভারমন্টে ছুটি কাটাচ্ছিলেন, তখন তারা এক বিশাল অচেনা প্রাণীর মাথা ও লম্বা ঘাড় দেখতে পান। সান্দ্রা তার সাথে থাকা ক্যামেরা দিয়ে সেই প্রাণীটির একটি ছবি তুলতে সক্ষম হন। পরে বিশেষজ্ঞরা জানান, এই ছবিটি ফেইক বা নকল নয়। তারা এটাও ধারণা করেন, খুব সম্ভবত এটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের plesiosaur গোত্রের কোন প্রাণী হতে পারে, যেটি এখনো টিকে আছে। এই উভচর জলজ প্রাণী প্রজাতি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আবার অনেকে এই ছবিটিকে তিমি মাছের পাখনা বলেও ধারণা করছেন। মূল সমস্যা হচ্ছে, সান্দ্রা হ্রদের ঠিক কোন স্থান থেকে ছবিটি তুলেছিলেন, সেটি মনে করতে পারছিলেন না। যে কারণে ছবিটি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। Lake Champlain Phenomenon Investigation এর প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক জোসেফ ডব্লিউ ঝারঝিনিস্কি গত বিশ বছর ধরে এই হ্রদ আর সেটিতে দেখতে পাওয়া রহস্যময় প্রাণী নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। জোসেফ জানান, গত ২০ বছরে চ্যামপ্লেইন লেকের এই রহস্যময় প্রাণীর দেখা পাওয়া গিয়েছে প্রায় ৩০০ বার। হ্রদের পানিতে শব্দ ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষা চালানো হয়েছে, যাতে হ্রদের পানিতে ‘কিছু’ একটার অস্তিত্ব বোঝা গিয়েছে, কিন্তু গবেষকরা কোন উপসংহারে পৌঁছতে পারেন নি। জোসেফ এই রহস্যময় প্রাণী সম্পর্কে এতোটাই নিশ্চিত যে, তিনি স্থানীয় ও রাজ্য সরকারকে এই অদেখা প্রাণী সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ করেন!
২০০৫ সালে গবেষকরা ‘ইকোলোকেশন’ পদ্ধতিতে হ্রদের পানির নিচে কোন রহস্যময় প্রাণী আছে কিনা সেটি নির্ণয় করতে চেষ্টা করেন। তারা হ্রদের নিচ থেকে যে প্রাণীর ডাক রেকর্ড করেন, সেটি তিনি বা ডলফিনের ছিল না। কারণ তিমি বা ডলফিন হ্রদে বাস করে না। বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসেন এই বলে যে, “আমরা যে প্রাণীর ডাক রেকর্ড করেছি, সেটি খুব উন্নত মস্তিষ্কের কোন প্রাণীর হবে, যেটা সম্পর্কে আমরা এখনো জানি না।“
সম্ভাব্য ব্যাখ্যা (১) হয়তো কোন সাধারণ প্রাণীকেই দানব হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। (২) পানিতে ভাসমান কোন জড়বস্তু কিংবা গাছ কিংবা গাছের ডাল হতে পারে। (৩) অর্থ কিংবা খ্যাতি লাভের জন্য কেউ কেউ গুজব ছড়িয়ে থাকতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত চ্যাম্পলেইন হ্রদের এই প্রাণী এখনো এক রহস্যই রয়ে গিয়েছে।