১৯৩০ সালে একজন সাংবাদিক দ্য পাস, ম্যানিটোবার নিকটবর্তী আজনিকুনি হ্রদের পাশেই এক ছোট আর নিভৃত গ্রামের কথা প্রকাশ করেন। হ্রদটি উত্তর পশ্চিম কানাডায় অবস্থিত। এই গ্রামটি পশুর লোম উৎপাদনের জন্য খ্যাত ছিল আর পশম কেনার জন্য সেখানে ব্যবসায়ীদের ভীড় লেগেই থাকতো। জো লাবেল নামের একজন পশম ব্যবসায়ী জানান, তিনি একদিন পশম সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গ্রামে যান। গিয়ে দেখেন গ্রামের সব মানুষ উধাও। শুধু তাই নয়, তারা যে শার্টগুলো বুনছিল সেগুলো অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, খাবারগুলো তখনো চুলোতে গরম হচ্ছিলো। এসব দেখে বোঝা গেল, গ্রামের সবাই আকস্মিকভাবে গ্রাম ত্যাগ করেছে। সাতটি কুকুরকে অনাহারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। এছাড়া গ্রামের একমাত্র কবরস্থানের সবগুলো কবর পাওয়া গেল খোদিত অবস্থায়! আর ভেতরের সবগুলো লাশ হয়ে গিয়েছিল উধাও! এটা কোন প্রাণীর কাজ নয়, কারণ কবরের সাথে যে পাথরের ফলক ছিল সেগুলো যথাস্থানেই ছিল। উৎকট এ দৃশ্য থেকে লেবেল দ্রুত the Royal Canadian Mounted Policeকে খবর দেন। তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত শুরু হলো গ্রামের নিখোঁজ মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য, কিন্তু কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না! আঞ্জিকুনি উপজাতীয় গোত্রের ২০০০ গ্রামবাসীকে এর পর আর কেউই দেখে নি।
লাবেল ১৯৩০ সালের ১২ নভেম্বর সকাল সাড়ে ন’টা থেকে সোয়া দশটার মাঝে গ্রামে ঢোকেন। গ্রামের অবস্থা দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেই গ্রামে তিনি ব্যবসায়িক কাজে গেলেও সেখানে তার কয়েকজন কাছের বন্ধু ছিল। তিনি তাদের বাড়িতে গেলেন। কিন্তু কেউ সেখানে ছিল না। আতঙ্কিত ও হতবিহবল লাবেল গ্রামের প্রতিটি বাড়ি, কুটিরে গিয়ে গিয়ে দেখতে লাগলেন কেউ আছে কিনা কিন্তু কেউই ছিল না। এমনকি লাবেল দেখলেন গ্রামে বসবাসকারীরা তাদের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব জিনিসপত্রই গ্রামে ফেলে গিয়েছে। ভয়ে লাবেলের গলা শুকিয়ে আসলো। গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে তিনি কাউকে পেলেন না। আর একবার তিনি পুরো গ্রাম ঘুরলেন। কিন্তু না, কোন প্রাণের সাড়াশব্দ বা চিহ্ন পাওয়া গেল না। তবে তখন পর্যন্ত আরো একটি স্থান খোঁজা বাকি ছিল। গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি মাছের আড়ত ছিল। এটি চালাতেন ফ্র্যান ম্যাকেঞ্জি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্ণেল। আর আড়তের নাম ছিল ‘ম্যাক শ্যাক’। এ স্থানটি গ্রামের অধিবাসীদের গল্প-গুজব, বাজার-সদাইয়ের স্থান ছিল। জায়গাটি সব সময় লোকে লোকারণ্য থাকতো। লাবেল ভাবলেন, সবাই হয়তো কোন উৎসব উপলক্ষে সেখানে গিয়েছে। ফ্র্যান ও অন্য বন্ধুরা সেখানেই আছে ভেবে লাবেল দ্রুত এগিয়ে যান। কিন্তু তার সব আশা চূর্ণ হয়ে গেল যখন তিনি দেখলেন সেখানেও কেউ নেই! পানীয়ের বোতলগুলো ছিল চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ফ্র্যানের বসার চেয়ারগুলো ছিল গায়েব! ফ্র্যানের ঘরে খোঁজাখুঁজি করার সময় লাবেল ঘরের জানালা দিয়ে দেখলেন বাড়ি থেকে ৪০০ গজ দূরের বনে আগুন লেগেছে। দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে তিনি দেখলেন একটি সিল মাছের চর্বিকে বা কারা রান্নাতে চড়িয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। কাছেই একটি পাথরের উপর একটি গোলাকার লেন্সের চশমা পড়ে থাকতে দেখা গেল। এটির রিম ছিল বাঁকানো কিন্তু লেন্সগুলো খুঁজে পাওয়া গেল না। লাবেল চশমা দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। এটি ছিল তার বন্ধু ও ঐ গ্রামের এস্কিমোদের প্রধান বেনিৎজি বেনি আটমোনিঞ্জির। কিন্তু বেনিৎজি তো কয়েক বছর আগেই জলবসন্ত রোগে ভুগে মারা যায়। তার এই বিশেষ চশমা তার কফিনের সাথেই দিয়ে দেয়া হয়েছিল। এটা এখানে কিভাবে এলো? লাবেল মাটিতে তাকিয়ে নিজের পায়ের ছাপ ছাড়া আর কারো পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন না।
লাবেল এবার পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মেজর থিওডোর লিস্টোর্ট এর নেতৃত্বে Royal Canadian Mounted Police পুরো গ্রাম ও আশেপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কোন গ্রামবাসীকে পাওয়া গেল না। তবে পুলিশ আরো ভয়াবহ কিছুর সন্ধান পাওয়া গেল। লেখক জর্জ সাভারভিও, যিনি এই অভিযানে উপস্থিত ছিলেন ১৯৩১ সালের জানুয়ারিতে নর্থওয়েস্ট জার্নালে এসংক্রান্ত ৫ পর্বের নিবন্ধ লিখেন। পুলিশ দেখলো, ঐ গ্রামের এস্কিমোদের পূর্বপুরুষদের সবগুলো কবর খোদিত অবস্থায় আছে আর সেগুলোর ভেতর থেকে লাশগুলো গায়েব! আর কবরগুলো পূর্ণ ছিল আবর্জনা দ্বারা। যে বা যেটি গ্রামবাসীদেরকে নিয়ে গেল সে কি একইসাথে কবরগুলোর ভেতরে থাকা লাশগুলোও নিয়ে গিয়েছে? কিন্তু কবরের উপরের মাটি বরফ জমে এতোটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে এগুলো খনন করা যে কারো জন্যই বেশ দুঃসাধ্য কাজ। শুধুমাত্র এই গ্রামের এস্কিমোদের সবচেয়ে প্রাচীন গোত্রপ্রধানের কবর অক্ষত ছিল। কিন্তু এস্কিমোদের ঐতিহ্য অনুযায়ী মৃতদের কবর খোঁড়া নিষিদ্ধ। অভিশাপের ভয়ে তদন্তকারী দল কবরটি না খুঁড়েই চলে গেল। তদন্তকাজ এখানেই শেষ। এই ঘটনার পরের বছরই সরকারি নির্দেশে কোন এক রহস্যময় কারনে গ্রামটি ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হয়। এরপরে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কিছু বাণিজ্যিক মানচিত্রে এই গ্রামের উল্লেখ থাকলেও এখন আর কোন মানচিত্রে এর অবস্থান উল্লেখ নেই।
কী হয়েছিল এই গ্রামের অধিবাসীদের? অনেকের মতে এক সাথে পুরো গ্রামের অধিবাসীদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মত অদ্ভুত ঘটনা আসলে ভিন্ন গ্রহের প্রাণীদের কাজ। কারণ হ্রদের আশেপাশে বেশ কিছু অদ্ভুত দর্শন সিলিন্ডারাকৃতির বুলেট সদৃশ বস্তু পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো আসলে কি ছিল সেটাই বোঝা যায় নি। এছাড়া ঘটনার রাত ও এর পরের রাতে পাহাড়ের উপর অদ্ভুত নীল আলো ভেসে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল। এখনো আঞ্জিকুনি হ্রদ আর এর পাশেই অবস্থিত গ্রামটি ‘দ্য ভিলেজ অব দ্য ডেড’ নামে পরিচিত।